রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪০ অপরাহ্ন
এহ্সান মাহমুদ:
পাগলা খালেককে দেখি না অনেকদিন। আবদুল খালেক সরদার যাকে আমরা পাগলা খালেক বলে ডাকতাম, আমাদের ছোটবেলায় দেখতাম খাসেরহাট বাজারের বাদামগাছের নিচে পাকা বেঞ্চিতে তিনি বসে থাকতেন। সকাল দুপুর সন্ধ্যা তাকে দেখতাম একই বেঞ্চিতে বসে আছেন। বৃষ্টির দিনেও তিনি ওখানেই থাকতেন। অল্প বৃষ্টিতে বসে বসে ভিজতেন। খুব ঝড়-বৃষ্টি হলে বাদামগাছের পাশেই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি। মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখতাম মাথার নিচে হাত দিয়ে বেঞ্চে শুয়ে আছেন। দীর্ঘদেহী মানুষটা বাঁকা হয়ে যখন শুয়ে থাকতেন তখন তাকে দেখতেও এই বেঞ্চের অংশই মনে হতো! পাগলা খালেক যে মারা গেছেন তা আমি জানতাম না। কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম বাজারের সেই বাদামগাছটিতে কোনো পাতা নেই। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম গাছটি মরে আছে। শুকিয়ে ডালপালা হারিয়ে কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। এই গাছটিই যে এক সময় সবুজ ডালপালা মেলে ছায়া দিত তা এখন অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। গাছটির নিচে দাঁড়িয়েই পাগলা খালেকের কথা মনে পড়ল। বাদামগাছের পাশেই এক দোকানির সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম পাগলা খালেক মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। আরও জানা গেল, মারা যাওয়ার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই এলাকা থেকে লাপাত্তা ছিলেন তিনি। কোথায় ছিলেন সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারল না।
আমাদের শৈশবেই আবদুল খালেককে নিয়ে অনেক কিছু জেনে গিয়েছিলাম আমরা। লোকের মুখে মুখে। তিনি একসময় বাজারে ব্যবসা করতেন। নিজের দোকান ছিল। খুবই শৌখিন ছিলেন। শ্যামলা রঙের শরীরে সবসময়ে টানটান জামা পরতেন। লুঙ্গি থাকত পরিষ্কার ধবধবে। শীতের দিনে কাঁধে শাল জড়িয়ে চলতেন। গরমের দিনে ঘাড়ে ও গলায় পাউডার মাখতেন। হেঁটে গেলে পথে সুগন্ধী ছড়াত। পারফিউম ব্যবহার করতেন। দোকানে বড় রেডিও ছিল। সেই রেডিওতে লোকজন খবর শুনতে জড়ো হতো সকালে আর সন্ধ্যায়। দুপুরের দিকে বসে বসে গানের অনুষ্ঠান শুনতেন আবদুল খালেক। একা একা।
এমন একজন মানুষ কী করে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন তার সুরাহা করতে পারতাম না আমরা। বাজারে গেলেই তাকে দেখা যেত কানের লতি ছাপিয়ে ঘাড় ছোঁয়া লতানো এলোমেলো ময়লা চুল, পরনে ধুলোবালি মাখা পুরনো লুঙ্গি আর গায়ে একটা মোটা পুরাতন কোট চাপিয়ে বসে আছেন বাদামতলায়। মুখে দাড়ি-গোঁফের আড়ালে তার চোখ দুটি জ¦লজ¦ল করে থাকত। আমরা ছোটরা তার থেকে দূরে থাকলেও একটু বড়রা মাঝেমাঝে তার কাছে এগিয়ে যেতেন। বাজারের পাশে রফিক ভাইদের বাড়ি। রফিক ভাই এবং আরও কয়েকজনকে মাঝেমাঝে দেখতাম আবদুল খালেককে সেলুনে নিয়ে বসাতেন জোর করে। চুল-দাড়ি কাটিয়ে দিতেন। তারপরে বাজারের পুকুরে নিয়ে যেতেন গোসল করাতে। এইভাবে বছরে দুই তিনবার পাগলা খালেককে দেখতে পেতাম পরিষ্কার মুখে। তখন তার মুখের আসল অবয়ব ধরা পড়ত। এককালের শৌখিন আবদুল খালেক সরদারের মুখটা তখন মনে করার চেষ্টা করতাম। এতদিন পরে খাসেরহাট বাজারের বাদামগাছের তলায় দাঁড়িয়ে পাগলা খালেক এবং মৃত বাদামগাছ ঘিরে আমাদের শৈশবের কথা মনে পড়ছিল। এমন একটা সময়ে আমি বাদামগাছটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম যে সময় আবদুল খালেক আর বেঁচে নেই। আর তার শেষ আশ্রয় বাদামগাছটিও নিঃশেষ হওয়ার অপেক্ষায়।
খাসেরহাট বাজারে একসময় পাগলদের বেশ আনাগোনা ছিল। বিশেষ করে, সপ্তাহে দুইদিন। হাটের দিন শুক্র এবং সোমবার কোনো না কোনো নতুন পাগলের দেখা মিলত। আশপাশের এলাকা থেকে পাগলরা এসে এখানে দু-চার দিন থাকত আবার চলে যেত। বাজারের পশ্চিম দিকে নদীর পাড়ে গোডাউনের পাশে, বাজারের উত্তর মাথায় রাইস মিলের সামনে আর বাদামতলায় পাগলদের দেখা মিলত। মাঝে মাঝে বাজার ছাড়িয়ে দক্ষিণের দিকে লঞ্চঘাটের দিকেও মাঝেমাঝে দেখা যেত। তবে দিনশেষে বাজার ছিল তাদের ঠিকানা। একটি বিষয় আমরা লক্ষ করতাম, বাজারে আসা পাগলদের প্রায় সবাই দিনের কোনো একটা সময়ে বাদামতলায় বেঞ্চিতে এসে বসতেন যেখানে পাগলা খালেক থাকতেন। মাঝেমাঝে আমরা তখন মজা করে বলতাম ‘পাগলের মেলা’ বসছে।
এই পাগলদের বিরুদ্ধে বাজারের কোনো ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল না। দোকানিরা খুশি হয়ে কিছু দিলে তারা খেতেন। কোনো দোকান থেকে খাবার নিয়ে যাওয়া, বা কিছু নিয়ে দৌড় দেওয়ার স্বভাব তাদের ছিল না। পাগলা খালেককে দেখতাম সকালে বাজারের কোনো হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। অনীল দাসের হোটেল কিংবা জামাল মোল্লার হোটেলের সামনে দাঁড়ালেই তার সকালের খাবার হয়ে যেত। একটি রুটির সঙ্গে সামান্য ভাজি দিলেই তার সকালের খাওয়া হয়ে যেত। হোটেলের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়েই গপাগপ খেয়ে নিতেন খালেক। একইভাবে অন্য পাগলদেরও খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যেত। তবে বাজারের স্থায়ী পাগল হিসেবে খালেকের আলাদা কদর ছিল।
এতদিন পর সন্ধ্যায় বাজারে একা একা হাঁটতে হাঁটতে কোনো পাগলের দেখা মিলল না। বিষয়টি প্রথম খেয়াল করিনি। কিন্তু বাদাম গাছের করুণ দশা থেকে পাগলা খালেক এবং একে একে অন্য পাগলের কথা মনে পড়ল। প্রবীণ এক চায়ের দোকানির সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করে চায়ের অর্ডার দিলাম। কথায় কথায় তিনি জানালেন, বাজারে এখন আর তেমন কোনো পাগল দেখা যায় না। কতদিন থেকে বাজারে কোনো পাগলের দেখা মেলে না জানতে চাইলেই অকপটে তিনি বললেন পাগলা খালেক হারিয়ে যওয়ার পর বাজারে আর কোনো পাগল দেখি না। সত্যি সত্যি পাগলা খালেক বাজার থেকে চলে যাওয়ার পরই আর কোনো পাগল খাসেরহাট বাজারে আসে না? দেশে কি তবে পাগলের সংখ্যা কমে গেল?
পাগলের সংখ্যা কমেছে কি না তা বলতে পারব না, তবে আবদুল খালেকের মতো পথের মানুষ যে এখনো আছেন তা বেশ দেখতে পেলাম মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটে। তবে সেই দেখাটি হলো খুবই নির্দয়। ঢাকায় ফিরছিলাম সেদিন। শীতের সকাল। কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। মাওয়া ঘাটের খাবার হোটেলগুলো খুলেছে। সেখান থেকে ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। তার পাশ দিয়েই হাঁটছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল একটি হোটেল থেকে সামান্য দূরে এক লোক বসে আছেন। সেখান থেকে কান্নার শব্দ আসছে। আর বিড়বিড় আওয়াজ বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। এমন বয়স্ক একজন লোক কাঁদছেন কেন, দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল খালি পা। সেই পায়ে হাত বুলাচ্ছেন তিনি। পায়ের ওপরের অংশ জুড়ে ফোসকা পড়েছে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ তুলে একবার দেখলেন। আবার নিচে তাকিয়ে ফোসকা পড়া পায়ে হাত বুলাতে শুরু করলেন। অল্প দূরেই একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সকালে খাবারের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন এক হোটেলের সামনে। ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছিল যেই কড়াইতে সেই কড়াইয়ের খুন্তি জাগিয়ে তাকে সরানোর চেষ্টা করছিলেন হোটেলের কর্মচারী। খুন্তির তেল গিয়ে পড়ে তার পায়ে। তাতেই পায়ের এই দশা।
করোনা মহামারীর এই কালে একদিকে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পরিসংখ্যান ছাপা হচ্ছে, আরেকদিকে পথেঘাটে এমন পথের মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক